Sandwip Tour

 

 

আসসালামু আলাইকুম।

সবাইকে স্বাগত জানাই সন্দ্বীপ ভ্রমণের এই শুভযাত্রায়। আজকের যাত্রার সূচনা হবে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের, বিখ্যাত কুমিরা ঘাট ঘর থেকে। পুরো ভ্রমণজুড়ে আপনাদের সাথে আছি  আমি, সাইমুন ইসলাম রাজিব, এবং আমার সঙ্গে রয়েছেন আমার সিনিয়র বড় ভাই, মি. আনোয়ার হোসেন।

যাত্রার শুরুতেই একটি বিশেষ বিষয় উল্লেখ করা জরুরি—সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট চট্টগ্রামের অন্যতম সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর স্থান। পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই স্থানের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এটি মূলত একটি পারাপারের ঘাট, তবে এখানে রয়েছে সুবিশাল দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিজ, যা জোয়ার ও ভাটার সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। কুমিরা ঘাটের বিকেলটা খুবই মনোরম। সাগরের গর্জন, শীতল হাওয়ার স্পর্শ আর সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য সেখানকার প্রকৃতিকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।

আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি সন্দ্বীপে যাওয়ার জন্য টিকিট সংগ্রহের দীর্ঘ লাইনে। স্পিডবোটে যাওয়ার জন্য লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করছি। লাইনে আছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ, শিশু, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। বেশ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে অনেকের চেহারায় ক্লান্তি ও বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। যদিও আমরা খুব সকালেই এখানে পৌঁছেছিলাম, তবু স্পিডবোটের টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।

এতসবের পরেও আমাদের কুমিরা ঘাট এসে কিছুটা হতাশ হতে হয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও টিকিট পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে আরও ভালো ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল। তবে এই জায়গার সৌন্দর্য এবং সমুদ্রের স্নিগ্ধ বাতাস আমাদের হতাশা কিছুটা হলেও দূর করেছে।

অবশেষে বাধ্য হয়ে সার্ভিস বোটের টিকিট সংগ্রহ করতে হয়েছে। প্রতি টিকিটের মূল্য প্রায় দেড়শ টাকা করে। এখন আমরা কুমিরার বিখ্যাত দীর্ঘ সেতুটি পাড়ি দিচ্ছি। এই সেতু এতটাই দীর্ঘ যে অনেক মানুষ ভ্যানগাড়ি ব্যবহার করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যান। তবে আমি পুরো সেতুটির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পায়ে হেঁটেই যাত্রা করছি।

এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। চারপাশের প্রকৃতি এতটাই মনোমুগ্ধকর যে মনে হয়, এটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সেতুর দুই পাশে সাগরের গর্জন আর ঢেউয়ের উপচে পড়া শব্দ পরিবেশকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। এখানকার প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

আমাদের এ যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। পুরো ভ্রমণজুড়ে সঙ্গে থাকুন এবং সন্দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী হোন।

আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে দীর্ঘ সেতুটি পেছনে ফেলে এবার সার্ভিস বোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজকের সকালটা যেন একেবারেই অন্যরকম। সৌভাগ্যক্রমে আমরা নিরাপদেই বোটে উঠে গিয়েছি। তবে এ যাত্রায় লক্ষ্য করলাম, বিশেষ করে নারীদের জন্য সাগর পাড়ি দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। বোটে ওঠার সময় সবাই পরস্পরের প্রতি যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

একটি লাল রঙের সার্ভিস বোট আমাদের যাত্রা শুরু করল। সাগরের গর্জনের সঙ্গে মিশে গেলো যাত্রীদের কথোপকথনের শব্দ। কিছু দূর এগোনোর পর বোট পরিবর্তন করতে হলো। অত্যন্ত সাবধানে একটি সবুজ বোটে উঠলাম। বোট পরিবর্তনের সময় একটু অসতর্ক হলেই বিপদ হতে পারে—পা পিছলে পড়ার ঝুঁকি থাকে।

সূর্যের কিরণ সাগরের পানিতে এসে ঝিকিমিকি করছে, যেন অসংখ্য মুক্তার মালা ভাসছে পানির উপর। এমন অপার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া সত্যিই কঠিন। আমি দ্রুত ক্যামেরা হাতে নিয়ে ভিডিওগ্রাফি শুরু করলাম।

এক ঘণ্টা দশ মিনিট পর আমরা সন্দ্বীপের গুপ্তছাড়া ঘাটে পৌঁছলাম। লোকমুখে শুনেছিলাম, সার্ভিস বোট যাত্রীদের এক কোমর পানিতে নামিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। আমরা শুকনো অবস্থায় নামতে পেরেছি। বোট থেকে নামার সময় সাদা পাখিগুলো আমাদের স্বাগত জানালো। প্রকৃতির এমন হৃদয়গ্রাহী পরিবেশ দেখে মন ভরে গেল।

গুপ্তছাড়া ঘাট থেকে প্রথম কাজ হলো সকালের নাস্তা খাওয়া। স্থানীয় একটি দোকানে হালকা নাস্তা করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম খামারবাড়ি যাব। ২০ মিনিটের যাত্রা শেষে খামারবাড়িতে পৌঁছলাম। রিসোর্টটির কাজ এখনো চলমান। তবে প্রাথমিক নান্দনিকতার ছোঁয়া মুগ্ধ করলো। আশপাশের পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর যে এখান থেকে ফিরতে মন চাইছিল না।

রিসোর্টের খাবারের মেনু দেখার পর দাম শুনে আমার বন্ধুর বিচি দুটো কাঁধে উঠে গিয়েছে, তাই সেখান থেকে খাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করলাম। কিছুক্ষণ রিসোর্টে থাকার পর আমরা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা করে রহমতপুর বাজারের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

রহমতপুর বাজারে পৌঁছে কাকড়া খাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কাকড়ার হাট বসেনি। অবশেষে স্থানীয় একটি সাইনবোর্ডহীন হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম। মোটা কাজল চালের ভাত, সহজ সরল রান্নার স্বাদে, তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করলাম, এবং দোকানদারের আন্তরিকতা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। দোকানদার ভাই, দেলোয়ার, একের পর এক ভাত পরিবেশন করছিলেন। এবং আমরা দুজন একের পর এক গিলে যাচ্ছি,  তার আন্তরিকতা সন্দ্বীপবাসীর অতিথিপরায়ণতার পরিচয় দিল।

দুপুরের খাবার শেষে আমরা বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চর দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে মহিষের একটি বড় পাল দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এ দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় বন্দি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সন্দ্বীপের সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছলাম। এখানকার এক তরুণ নতুন একটি হোটেল তৈরি করছেন। সূর্যের আলোয় চারপাশের পরিবেশ এক অনন্য আবহ তৈরি করেছে।

আজকের যাত্রার স্পন্সর ছিল সন্দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী বিনয় মিষ্টি মুখ। এখানে পাওয়া যায় সুস্বাদু মিষ্টি এবং অরিজিনাল মহিষের দধি। দোকানদার আমাদের এক কেজি মিষ্টি হাতে দিয়ে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। তবে আপনারা চাইলে এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি অনলাইনে থেকেও ক্রয় করতে পারেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমরা গুপ্তছাড়া ঘাটে ফেরার জন্য রওনা দিলাম। ৪০ মিনিট পর ঘাটে পৌঁছে স্পিডবোটের টিকিট সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিকিট হাতে পাওয়ায় আনন্দিত হয়ে উঠলাম। সন্দ্বীপবাসীর যাতায়াতের কষ্ট firsthand উপলব্ধি করলাম।

এভাবে শেষ হলো সন্দ্বীপের এক বিস্ময়কর দিন। দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য ও মানুষের আন্তরিকতা স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে।

লেখকঃ সাইমুন ইসলাম রাজিব

Scroll to Top